কক্সবাজারের টেকনাফে থেকেও চট্টগ্রামে এভাবে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তার যত কু-কর্ম শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকেই। এসআই হিসাবে পুলিশে যোগ দেওয়ার পর ঘুরে ফিরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২৫ বছর কাটিয়ে দেওয়া এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ ভয়ঙ্কর সব অভিযোগের শেষ নেই। তার বিরুদ্ধে স্বজাতি এমনকি আত্মীয়-স্বজনের জমি দখলের অভিযোগ আছে।
তবে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পেত না। সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান খুনের ঘটনায় কারাবন্দি হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তার গুলিতে স্বজনহারা, জীবনের তরে পঙ্গুত্ব বরণকারীরা আইন আদালতের আশ্রয় নেওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
অনৈতিক কর্মকাÐের মাধ্যমে প্রদীপ আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা। দেশ-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। চট্টগ্রাম নগরীতেই তার নামে বেনামে বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। জানা গেছে তার অবৈধ অর্থ-বিত্তের খোঁজে মাঠে নেমেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
ডিবি ছাড়াও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তিন থানার ওসি ছিলেন প্রদীপ কুমার দাশ। তবে সবকটি থানা থেকে তাকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে নানা অপকর্মের কারণে। সিএমপিতেই তার বিরুদ্ধে অন্তত পাঁচ বার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তার কিছুই হয়নি। প্রতিবারই টাকার বস্তা আর প্রভাবশালীদের দিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছেন। নগর পুলিশে দায়িত্বপালন কালে অসৎ কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ মদদ পেতেন প্রদীপ। বিনিময়ে তারা পেতেন অবৈধ আয়ের ভাগ। এতে দিনে দিনে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেন এই কর্মকর্তা। বরখাস্ত অবস্থায়ও তাকে গানম্যান নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরতে দেখা যেত। পেশাদার ও সৎ যেসব কর্মকর্তা তার অপকর্ম প্রশ্রয় দিতেন না প্রদীপ তাদের পাত্তাই দিতেন না।
বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি থাকাকালে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদাবাজির ঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়। ওই ব্যবসায়ী তৎকালীন আইজিপি একেএম শহীদুল হকের ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে কম সময়ের মধ্যে প্রদীপ চাকরি ফিরে পান। নগর পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সে এতটাই প্রভাবশালী ছিলো যে তার জন্য অনেক বড় বড় জায়গা থেকে ফোন আসতো।
বিএনপির আমলে চাকরিতে আসা প্রদীপ দাশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বেপরোয়া হয়ে উঠে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের পর রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীদের দমনে প্রদীপ হিং¯্র হয়ে মাঠে নামেন। তার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের প্রকাশ্যে গুলি করার অভিযোগ আছে। পাঁচলাইশের ওসি থাকাকালে বুটজুতা পায়ে নামাজরত এক মুসল্লির পায়ে গুলি করে রক্তাক্ত করে উল্লাস প্রকাশ করেন প্রদীপ ও তার সহযোগীরা। এই ঘটনায় তখন ব্যাপক জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হলেও পুলিশ বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি বেশি দূর গড়ায়নি। এরপর বোরকা পরা এক বৃদ্ধাকে রাজপথে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হলে পাঁচলাইশ থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয় ওসি প্রদীপকে।
২০১৩ সালে একটি মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে তার রিমান্ডের আবেদনের বিরোধিতা করায় এক আইনজীবীকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় প্রদীপসহ আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওই আইনজীবী। একই বছর একটি কমিউনিটি সেন্টার থেকে শিবির আখ্যা দিয়ে ৪০ ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকে আটক করেন প্রদীপ। এই ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিতও হন তিনি। সাধারণ মানুষকে থানায় ধরে এনে জামায়াত-শিবির বানিয়ে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ছেড়ে দিতেন। এমন অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
তার আগে পতেঙ্গা থানার ওসির দায়িত্ব পালনকালে আদালতের অনুমতি ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা দেওয়া, বার্জ আটক এবং বার্জ মালিকসহ ১২ ব্যক্তিকে মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। পুলিশ সদর দফতর গঠিত তদন্ত কমিটি প্রদীপকে অভিযুক্ত করলে পতেঙ্গা থানা থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। তার বিরুদ্ধে মানুষকে থানায় ধরে এনে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে অনেক। পাঁচলাইশ এলাকায় এক বোনের জমি দখল এবং কোতোয়ালী এলাকায় এক হিন্দু নারীর জমি দখলের অভিযোগও আছে। নগরীতে তার একাধিক বাড়ি রয়েছে। নগরীর ব্যবসায়ীদের কাছে এক আতঙ্কের নাম ছিল প্রদীপ কুমার দাশ। তার বিরুদ্ধে অনেকে অভিযোগ করার সাহস পেতেন না। আবার বেশির ভাগ অভিযোগই চাপা পড়ে যেত। জানা গেছে ভুক্তভোগীরা এখন তার বিরুদ্ধে মামলা, মোকদ্দমাসহ আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।